Biography of Swami Vivekananda in Bengali – “স্বামী বিবেকানন্দ” এই নামটির সাথে আমরা খুব ভালোভাবে পরিচিত তবে আজ আমরা ভারতের পবিত্র ভূমিতে জন্মগ্রহণকারী মহান সন্ন্যাসী ও দার্শনিক স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী সম্পর্কে জানবো।
স্বামী বিবেকানন্দ তার কাজকর্মের জন্য ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের কাছে জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠে। তিনি ভারতবর্ষের বেদ- বেদান্ত, ভারতীয় সংস্কৃতি ও ভারতবর্ষের গৌরবময় ইতিহাসকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচার করেন। তিনি পরমহংস রামকৃষ্ণ দেবের অন্যতম প্রধান শিষ্য ছিলেন। তাহলে আর দেরি না করে সেই মহাপুরুষ “স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ও ইতিহাস” ও তার সম্পর্কে কিছু আকর্ষণীয় তথ্য সম্বন্ধে জেনে ফেলি।
স্বামী বিবেকানন্দের সংক্ষিপ্ত জীবনী – Swami Vivekananda Jibon Kahini Bengali
নাম | নরেন্দ্রনাথ দত্ত |
জন্ম | ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি উত্তর কলকাতায় |
পিতা ও মাতা | পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ও মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী |
ঠাকুরদার | দূরপ্রসাদ দত্ত |
গুরু | শ্রী শ্রী পরমহংস রামকৃষ্ণ দেব। |
বিবেকানন্দ নামটি দেন | রাজা অজিত সিং |
স্বামীজির উল্লেখযোগ্য শিষ্য | ভগিনী নিবেদিতা, |
Swami Vivekananda Biography in Bengali
[এই পোস্টটিকে আপনি যেসব প্রশ্নের উত্তর এর জন্য ব্যাবহার করতে পারেন সেগুলি হলো – স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী রচনা, স্বামী বিবেকানন্দের ইতিহাস ,স্বামী বিবেকানন্দের সংক্ষিপ্ত জীবনী, Swami Vivekananda Bangla Biography, স্বামীজীর জীবনী।]
স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ও তার ইতিহাস
জন্ম ও পরিবার
১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি উত্তর কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দ জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা নাম ছিল বিশ্বনাথ দত্ত ও মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী। স্বামী বিবেকানন্দ ঠাকুরদার নাম হল দূরপ্রসাদ দত্ত তিনি একজন সন্ন্যাসী ছিলেন যা করণে তিনি বেশিরভাগ সময় ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তেন।
স্বামী বিবেকানন্দের পিতা শ্রী বিশ্বনাথ দত্ত কলকাতা উচ্চ আদালতের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী ছিলেন তার মাতা সংসারের সমস্ত কাজকর্ম সামলাতেন ও নিয়মিত পূজা পাঠ করার সাথে সাথে রামায়ণ, মহাভারত শাস্ত্রপাঠ করতেন। স্বামী বিবেকানন্দ ছোট বেলা থেকে তার নয় জন ভাই বোনের সাথে বেড়ে উঠে। তাদের মধ্যে এক ভাই পরবর্তীকালে স্বামীজীর সাথে সন্ন্যাস জীবনে সঙ্গী হন।
স্বামী বিবেকানন্দের শৈশবকাল
স্বামী বিবেকানন্দের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ কিন্তু তাকে ছোটবেলায় নরেন বা বিলে নামে বেশি ডাক হতো।
ছোটবেলায় নরেন ছিল খুব জেদি ও দুরন্ত মনের বালক ছিল তিনি যা মনে করতেন তাই করতেন। মাঝে মধ্যে খেলায় খেলাই সে সন্ন্যাসী সাঁজতে আর তার মা কে গিয়ে বলতো দেখি মা আমি কেমন শিব সেজেছি। এই দেখে তার মা মাঝে মাঝে চিন্তিত হয়ে বলতেন তিনি তার ঠাকুরদার মত সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ত্যাগ না করে।
শৈশবকাল থেকেই নরেন আধ্যাত্মিক দিক আগ্রহ ফুটে উঠে। তিনি ছোটবেলা থেকেই রামসিতার এবং শিবের মূর্তি পূজা করতেন এবং দীর্ঘক্ষণ পূজা করতে করতে ধ্যান মগ্ন হয়ে যেতেন।
নরেন যখন ছোট ছিল দুষ্টুমি করার পাশাপাশি পড়াশোনা ও খেলাধুতাও শীর্ষে ছিলেন। এমনকি তার গান বাজনা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল।
নরেনের প্রথম শিক্ষা তার মা এর কাছে থেকে শুরু হই। তার মা তাকে সর্বপ্রথম বাংলা এবং ইংরেজি ভাষার বর্ণমালা গুলির শিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়া তার মা তাকে রমায়ান এবং মহাভারতের বিভিন্ন গল্প শুনতেন যা নরেন খুবই মনোযোগ সহকারে শুনতেন।
স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা জীবন (Swami Vivekananda Education in Bengali)
এরপর নরেন যখন ৮ বছর বয়সের হয় তখন তার মাতা পিতা তাকে লেখাপড়া করিয়ে একজন বড় মানুষ করতে চেয়েছিলেন যা স্বাভাবিক সেই কারণে ১৮৭৭ সালের নরেনকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি তার প্রাথমিক পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকে।
কিন্তু ১৮৭৭ সালে তার পিতার চাকরির কারনে নরেন সহ সহপারিবার ছত্তিসগড় রাজ্যের রায়পুর শহরে সাময়িককালের জন্য চলে যান।
১৮৭৯ সালে নরেনের পরিবারে আবার কলকাতায় ফিরে আসে, তখন নরেনের বয়স হয়েছিল ১৬ বছর, কলকাতায় এসে নরেন আবার তার পড়াশোনা শুরু করার জন্য সেই সময়ে কলকাতার সবথেকে বিখ্যাত কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন। এবং তিনি সেই পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয় এমনকি তিনি সেই বছর প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়া একমাত্র ছাত্র ছিলেন। এই থেকেই আমার স্বামী বিবেকানন্দের পড়াশোনা প্রতি ভালোবাসা ও কৌতুহল সম্পর্কে জানতে পারি।
এই কৌতূহল তাঁকে দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, সামাজিক বিজ্ঞান, সাহিত্য, বেদ, উপনিষদ, ভাগবত গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ এবং অন্যান্য বিষয়গুলিরও এক মহান জ্ঞানী করে তুলেছিল।
নরেন্দ্রনাথ আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির সংগীতের ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় সংগীতের গভীর প্রশিক্ষণও পেয়েছিলেন। তিনি কেবল শিক্ষার ক্ষেত্রে আগ্রহী নন, তিনি নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন ও খেলাধুলায়ও অংশ নিতেন।
শ্রী শ্রী পরমহংস রামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ
স্বামী বিবেকানন্দ একজন মেধাবী ছাত্রের সাথে সাথে বিভিন্ন ধর্মের প্রতি তার আগ্রহ ছিল কিন্তু তিনি তার যৌবনকালে স্নাতক পাস করার পর নাস্তিক বাদের দিকে ঝোঁক পড়তে থাকে।
সেই সময়েই ১৮৮১ সালে তিনি এক মহান আত্মা শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় যাকে তিনি পরবর্তীকালে তিনি নিজের গুরুর মর্যাদা দেন।
স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ দেবের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই নরেন্দ্রনাথ এর জীবনে এক নতুন পরিবর্তন আনে এবং তিনি নরেরে মধ্যে আধ্যাত্মিক এর প্রতি বিশ্বাস জাগ্রত করেন। পরমহংস রামকৃষ্ণ দেব জহুরির মতন নরেন্দ্রনাথের মতো এক রত্ন কে চিনতে পারেন।
স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ
এরপর যখন নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ দেবার সাথে দ্বিতীয়বার জন্য আলাপ করার জন্য দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে যান সেখানে কৌতুহলী নরেন সোজাসুজি পরমহংস রামকৃষ্ণ দেবকে প্রশ্ন করেন যে তিনি ঈশ্বরকে দেখেছেন কি না এই প্রশ্নের উত্তরে পরমহংস রামকৃষ্ণ বলেন – “হ্যাঁ আমি ঈশ্বর দেখেছি, তোমাকে যেমন দেখেছি সেরকম স্পষ্ট দেখছি।”
এই উত্তরটি টি শুনে নরেন্দ্রনাথ অবাক হয়ে গিয়েছেন এবং প্রথম প্রথম তিনি ব্যাপারটি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
তখন পরমহংস রামকৃষ্ণ দেব নরেন্দ্রনাথ কে সহজ, স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতার সাথে বুঝিয়ে ছিলেন যে – “এটি সত্য যে বাস্তবে ঈশ্বর রয়েছে এবং মানুষ তার কর্ম, আনুগত্য ও সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরকে লাভ করতে পারে।”
রামকৃষ্ণ দেবের এই কথা গুলোতে স্বামী বিবেকানন্দ ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং ১৮৮১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও পরবর্তী ৬ বছর ধরে তিনি রামকৃষ্ণের কাছে থেকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করতে থাকে।
পরে রামকৃষ্ণ দেব তার শিষ্য নরেন্দ্রনাথকে এই শিক্ষা দিয়েছিলেন যে – “জীবের সেবা করা ঈশ্বর আরাধনা করার সমান।”
পরবর্তীকালে নরেন্দ্রনাথ অর্থাৎ স্বামী বিবেকানন্দ তার গুরুর কাছে থেকে প্রাপ্ত এই শিক্ষা গুলিকে তার জীবনের দর্শন করে নিয়েছিলেন ও সেই শিক্ষা ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশে যাত্রা করার পরিকল্পনা করে।
স্বামী বিবেকানন্দের সন্ন্যাস গ্রহণ
১৮৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে, নরেন্দ্রনাথ কিছু সন্ন্যাসীদের দ্বারা আমন্ত্রণ করা হয়। সন্ন্যাসীদের কথা রাখার জন্য তিনি আঁটপুর গ্রামে যান। এবং সেখানে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।
নরেন্দ্রনাথ থেকে স্বামী বিবেকানন্দ হওয়ার গল্প
স্বামীজীর পিতা ও মাতার দেওয়া নামটি ছিল নরেন্দ্রনাথ বা নরেন কিন্তু কিভাবে নরেন্দ্রনাথ থেকে স্বামী বিবেকানন্দ নামটিকি করে হলো এই ব্যাপারে একটি ছোটো গল্প রয়েছে।
সন্ন্যাসী জীবন অবলম্বন করার পর যখন স্বামীজি ১৮৯৩ সালে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে ভারতের যাত্রা শুরু করেন।
তার ভারত ভ্রমনকালে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে, স্বামী বিবেকানন্দ আবু পর্বতের রাজা অজিত সিংহের সাথে প্রথম সাক্ষাত হয় এবং প্রথম সাক্ষাতেই রাজা অজিত সিং নরেন্দ্রনাথ দত্তের কথা ও ব্যক্তিত্বের প্রতি মুগ্ধ হয় এবং তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব স্থাপন হয়। সেই কারণে রাজা অজিত সিং স্বামীজিকে রাজস্থানে তার রাজপ্রাসাদে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
নরেন্দ্র অর্থৎ স্বামীজী, তার কথায় সম্মান জানিয়ে ভারত সফরকালে ১৮৯৩ সালের ১৮ জুন ক্ষেত্রীর রাজা অজিত সিংহের প্রাসাদে পৌঁছেছিলেন। রাজার অনুরোধে নরেন্দ্রনাথ সেখানে মোট দুই মাস অবস্থান করেন।
এদিকে, নরেন্দ্রনাথ এবং রাজা অজিত সিং এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের বিকাশ ঘটে। একই সাথে, অজিৎ সিং তার সমস্ত বৈশিষ্ট্য ভেবে এবং তার দক্ষতার বিশ্লেষণ করে নরেন্দ্রনাথ দত্ত থেকে “বিবেকানন্দ” নাম পরিবর্তন করেছিলেন।
নামটি দুটি শব্দের সংমিশ্রণ থেকে এসেছে – বিবেক + আনন্দ, যার মধ্যে ‘বিবেক’ অর্থ ‘বুদ্ধি’ এবং ‘আনন্দ’ অর্থ ‘সুখ’।
আরো পড়ুন – স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও উক্তি
স্বামী বিবেকানন্দের ভারত ভ্রমণ
১৮৮৫ সালে স্বামী বিবেকানন্দ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে তিনি এক জায়গায় স্থির না থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করে ভারতের সংস্কৃতি ও বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায় সম্পর্কে আরও গভীর ভাবে জানবেন।
সেই করেন স্বামীজী তার মঠ ত্যাগ করেন এবং ভারতবর্ষ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। স্বামী বিবেকানন্দের যাত্রার সঙ্গী ছিলেন একটি কমগুতু, লাঠি এবং তার প্রিয় গ্রন্থ ভগবত গীতা।
উত্তর ভারত ভ্রমন – স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৮৫ সাল থেকে উত্তর ভারতের বারাণসী থেকে ভারত ভ্রমণের যাত্রা শুরু করেন। একে একে তিনি ১৮৮৮ থেকে ১৮৯০ এর মধ্যে উত্তর ভারতের ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যেমন – আয়োধা, লখনৌ, বৃন্দাবন, ঋষিকেশ, ইত্যাদি ও উত্তর ভারতের বিভিন্ন তীথ স্থান ভ্রমণ করেন।
স্বামীজী তার ভারত ভ্রমনকালে বিভিন্ন স্থান দর্শনের সাথে সাথে সেখানে বিভিন্ন সভা ও আলোচনার মাধ্যমে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ও ভারতীয় সংস্কৃতির ব্যাপারে মানুষের মধ্যে জাগরণ গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন। উত্তর ভারতের সেই রকম একটি ধর্মীয় সভায় স্বামীজীর সাক্ষাৎ স্টেশন মাস্টার শরৎচন্দ্র গুপ্তের সাথে হয় যিনি পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দের প্রথম শিষ্য হিসেবে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে “সদানন্দ” নামে পরিচিতি লাভ করেন ।
এরপর স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯০ সালে শেষের দিকে ভারতের আরো উত্তর প্রান্তের ভ্রমণের জন্য অগ্রসর হন। এই সময় তিনি উত্তরাখন্ড ও হিমালয়ের দর্শন করেন। সেখানে স্বামীজী তার অন্যান্য গুরু ভ্রাতা স্বামী ব্রহ্মানন্দ, সারদানন্দ, তুরীয়ানন্দ, অখণ্ডানন্দ ও অদ্বৈতানন্দের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এবং তাদের সাথে ধর্ম ও বেদ-বেদান্ত নিয়ে বৈঠক করেন।
পশ্চিম ভারত ভ্রমন – উত্তর ভারতের যাত্রা সম্পর্ণ করে ১৮৯১ সালে প্রথম দিকে তিনি যখন দিল্লির ঐতিহাসিক স্থান গুলো দর্শনের পর পশ্চিম ভারতের রাজস্থানে গিয়েছিলেন। স্বামীজী রাজস্থানের ক্ষেত্রীর রাজা মহারাজ অজিত সিংহের সাথে বন্ধুর সম্পর্ক থাকার কারণে তিনি তার রাজপ্রাসাদে কয়েক মাস কাটানোর পর ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর তিনি পশ্চিম ভারতের অন্যান্য প্রান্ত পরিদর্শনের জন্য রওনা দেন।
১৮৯২ সালের প্রথমদিকে রাজস্থান থেকে তিনি ভারতের পশ্চিম প্রান্তের গুজরাটের আমেদাবাদ শহরে উপস্থিত হন এবং সেখানকার ঐতিহাসিক স্থান গুলি দর্শন করেন। এখানেই তিনি জসওয়ান্ত সিংহ নামক এক ভদ্রলোকের আলাপ হয় যিনি পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করে এসেছিলেন। তিনিই স্বামী স্বামীজীকে ভারতের সংস্কৃতি ও বেদ-বেদান্ত এর ব্যাপারে পশ্চিমের দেশগুলোতে প্রচার করার ধারণা দেয়।
এরপর তিনি একে একে পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পুনে থেকে শুরু করে কাছের রণ পর্যন্ত যাত্রা করেন। স্বামী বিবেকানন্দ পশ্চিম ভারতে আমেরিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম মহাসভা ব্যাপারে জানতে পারেন। সেখান থেকে তিনি মুম্বাই হয়ে দক্ষিণ ভারতের দিকে রওনা দেয়।
দক্ষিণ ভারতের উদ্দেশে রওনা – ১৮৯২ সালের শেষের দিকে স্বামী বিবেকানন্দ দক্ষিণ ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে এসে পৌঁছান ও দক্ষিণ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ স্থান গুলো ভ্রমনের সাথে সাথে ধর্মীয় সভার আয়েজন করেন।
১৮৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি দক্ষিণে ভারতের শেষ প্রান্ত কন্যাকুমারী পৌঁছান। অনেকের মতে স্বামীজি “ভারতীয় পাহাড়ের শেষ প্রান্তে” তিন দিন ধরে ধ্যান করেন যা পরে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল হিসেবে বিখ্যাত হয়।
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো যাওয়ার পূর্বে
স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের সবথেকে বড়ো উপলব্ধি হিসেবে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে তার বক্তৃতার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এই সম্মেলনে যোগদানের আগে পর্যন্ত তিনি ভারতীয়দের অন্তরে ও মনের মধ্যে ছিলেন কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত ধর্ম সম্মেলনে অংশ গ্রহণের পর থাকে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে মান সম্মান ও খ্যাতি পান, সেই সময়কালে ভারতবর্ষের নাম উজ্জ্বল করেছেন।
এই ধর্মীয় সম্মেলনের মাধ্যমে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবর্ষের সংস্কৃতি, ভারতীয়দের বিশ্বাস ও ভারতীয় ভূমির গৌরবময় ইতিহাস সমগ্র বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন।
কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো গিয়ে সেখানে ধর্ম সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার খুব একটা সহজ ছিল না কারণ স্বামীজী যখন ধর্ম সম্মেলন এর আয়োজন এর ব্যাপারে জানতে পারে তখন তার কাছে আমেরিকার শিকাগো শহরে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ ছিল না এবং তাকে এমন কি সেই বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য তাকে আমন্ত্রণ করা হয়নি।
কিন্তু স্বামীজীর খুব ইচ্ছা ছিল একটি বিশ্ব মঞ্চ থেকে ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পশ্চিমের দেশগুলোতে প্রচার করা। স্বামী বিবেকানন্দ তার সেই আখ্যাঙ্খাও মনে রেখে দেয় ও ১৮৯৩ সালে ভারত ভ্রমন কালে রাজা অজিত সিং সাথে সাক্ষাৎ হয়।
এই সময়টা একের পর এক আলোচনায় তিনি অজিত সিং এর সামনে তার শিকাগো গিয়ে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। স্বামী বিবেকানন্দ কথা শুনে রাজা অজিত সিং এর দেরি না করে স্বামী বিবেকানন্দকে শিকাগো যাওয়ার সুবন্দোবস্ত করে দেন। এবং তিনি এই পুন্য কাজের জন্য নিজেকে গর্বিত বলে মনে করেছিলেন।
বিশ্বধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা
এরপর স্বামী বিবেকানন্দ তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য আমেরিকা শিকাগো শহরে পৌঁছায়, এবং সেখানে এক অধ্যাপক এর সাথে স্বামীর আলাপ হয় এবং তিনি কিছু দিন তার বাড়িতে থেকে ছিলেন।
তারপর ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সম্মেলনের দিনটি আসে, সেখানে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
ভারতীয় প্রতিনিধি হিসাবে বিবেকানন্দের নাম শুনে সবাই অবাক হয়ে আলোচনা করতে শুরু করেন। পরাধীন ভারতের মানুষ কী বার্তা দেবে? এমনকি সেখানে তারা স্বামী বিবেকানন্দের পোশাক দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
ততক্ষণে পাশ্চাত্য সভ্যতার সমস্ত জ্ঞানী লোক তাদের বক্তৃতা দিয়েছিল। তারপর একজন আমেরিকান অধ্যাপক পূর্ব থেকে আগতদের সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছিলেন এবং তারপরে পূর্ব সভ্যতা থেকে আগত বিবেকানন্দ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং বিবেকানন্দ সমাবেশকে সম্বোধন করার মঞ্চে পৌঁছামাত্রই। তাঁর ভারতীয় হিন্দু ধর্ম, তার সংস্কৃতি এবং গুরুকে স্মরণ করে তিনি এই সমাবেশকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “আমার আমেরিকান বোন এবং ভাইয়েরা।”
তার এই কথা শুনা মাত্র বিশ্ব ধর্মসভা উপস্থিত সকল দর্শক গণ হাততালি দিয়ে উঠে এবং সাধুবাদ জানাই। তারপর স্বামীজি ভারতের সংস্কৃতি, ধর্ম, বেদ বেদান্ত ইত্যাদি সম্পর্কে তার বক্তব্য তুলে ধরে।
স্বামী বিবেকানন্দ বক্তব্য শুনে সকল দর্শকগণ বিশেষভাবে প্রভাবিত হয় এবং ভারতবর্ষ ও ভারতের সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে তাদের মনোভাব পরিবর্তন ঘটে।
এরপর ধর্ম সম্মেলনে সম্পন্ন হওয়ার পর স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকায় ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত থেকে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচার করতে থাকেন।
ইংল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ধর্ম প্রচার
স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকায় ধর্ম প্রচার করে দু বছর পরে ১৮৯৫ এর আগষ্ট মাসে তিনি ইউরোপে যান।
প্যারিস ও লন্ডনের মতন বড়ো বড়ো শহরে ধর্ম প্রচার করে ডিসেম্বর মাসে আবার আমেরিকায় ফিরে আসেন।
১৮৯৬ এর ১৫ই এপ্রিল আমেরিকা থেকে বিদায় নিয়ে আবার লন্ডনে আসেন।
স্বামীজীর দেশে ফিরে আসা
স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্যের গুলিতে ভারতীয় সংস্কৃতি ও প্রচার করে ১৮৯৭ সালে নিজের দেশে ফিরে আসার জন্য রওনা দেই
এবং প্রথমে তিনি শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে একটি বন্দরে পৌঁছান যেখানে স্বামীজি কে স্বাগত করার জন্য তার শিষ্য গণ ও একাধিক মানুষের সমাগম ঘটে।
স্বামী বিবেকানন্দ কলম্বো থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় পৌঁছায়। এর পর একের পর এক স্বামীকে দেশ বিদেশ থাকে অভিনন্দন আসতে থাকে। বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে বক্তৃতা ও দেশ বিদেশে তার ধর্ম প্রচার পর থেকে স্বামীর জীবনে সব থেকে বড় উপলব্ধি বলে অনেকে মনে করেন।
রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা
স্বামী বিবেকানন্দ দেশে ফিরে আসার পর সর্বপ্রথম রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন এর প্রতিষ্ঠা করার জন্য উদ্যোগী হন।
স্বামী বিবেকানন্দের পাশ্চাত্যের বন্ধুরা ও শ্রী রামকৃষ্ণ দেবে ভক্তরা রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্বামীজি আর্থিক দিক থেকে সাহায্য করেন।
এরপর স্বামীজি ১৮৯৭ সালে ১ মে কলকাতায় ধর্ম প্রচার ও কর্ম যোগ করার জন্য রামকৃষ্ণ দেবের ভক্ত দের জন্য ” রামকৃষ্ণ মঠ” এর প্রতিষ্ঠা করেন।
এবং পরে এক বছরের মধ্যে ১৮৯৮ সালের ৯ই ডিসেম্বর সামাজিক কাজকর্ম ও মানুষদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে ” রামকৃষ্ণ মিশন” এর প্রতিষ্ঠা করেন।
স্বামী বিবেকানন্দের দ্বিতীয়বার পাশ্চাত্যের ভ্রমণ
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৯ সালের মাসে পাশ্চাত্য ভ্রমনের উদেশে দ্বিতীয় বারের জন্য রওনা দেন।
স্বামীজী এই বার একা যাননি বরং তার সাথে সঙ্গী ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা ও স্বামীজীর শিষ্য স্বামী
স্বামী বিবেকানন্দ তার দ্বিতীয় বারের বিদেশ যাত্রায় প্রথমে ইংল্যান্ডে কিছুদিন থেকে আগস্ট মাসে আমেরিকার তে পৌঁছায়। এবং আমেরিকায় তিনি এক বছরে একাধিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
এই বার স্বামীজীর পাশ্চাত্য ভ্রমনের আসল উদ্দেশ ছিল তার প্রতিষ্ঠিত স্থান গুলোতে কাজকর্ম কেমন চলছে সেই ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়া।
এরপর স্বামী বিবেকানন্দ তার পাশ্চাত্য ভ্রমণ সম্পূর্ণ করে ১৯০০ সালের ৯ই ডিসেম্বর তিনি আবার কলকাতায় বেলুড় মঠে ফিরে আসে।
স্বামী বিবেকানন্দের অবদান
শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান কারণে তার নাম ইতিহাসের পাতায় সুবর্ণ অক্ষরে লেখা রয়েছে।
স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ভ্রমনকালে সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা ও স্ত্রী শিক্ষার প্রসার দেখে তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
সেই করেন তিনি দেশে ফিরে মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য উদ্যোগী হন। শিক্ষা নিয়ে স্বামীজি বলেছেন – “মানবের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশ সাধনই হল শিক্ষা।”
বিস্তারিত পড়ুন – নারী শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা
শিক্ষা ছাড়াও স্বামীজী সেই সময় ভারতে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার গুলোর বিরুদ্ধে সরব হন এবং মানুষকে জাগ্রত করে তোলার জন্য ব্যাপক অভিযান চালায়।
স্বামী বিবেকানন্দের শেষ জীবন
এটাতো সবথেকে বড় সত্য যে জন্মগ্রহণ করে তাকে একদিন না একদিন এই পৃথিবী মায়া ত্যাগ করে যেতে হবে। তবে মহান ব্যক্তিরা তাদের কর্মের দ্বারা চিরকালের জন্য অমর হয়ে যায় মানুষের মনের মধ্যে।
১৯০২ সালের ৪ জুলাই স্বামীর বয়স যখন প্রায় ৪০ বছর, তিনি তার নিয়মিত দৈনিক কাজকর্ম সম্পূর্ণ করে। এরপর তিনি বিকেল ৪ টার সময় তিনি তার যোগ আভাস ও শিষ্য দের বেদ, সংস্কৃতি ও যোগ সাধনার ব্যাপারে শিক্ষা দিয়ে।
তারপর সন্ধে ৭টা নাগাদ সেই বেকুরামকৃষ্ণ মঠের নিজের ঘরে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নিজেকে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় রেখে পরলোক গমন করেন।
স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কটি কিছু তথ্য (FAQ on Swami Vivekananda in Bengali)
স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম তারিখ?
১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি।
স্বামী বিবেকানন্দের জন্মস্থান কোথায়?
উত্তর কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেন।
স্বামীজিকে “বিবেকানন্দ” নামটি কে দেন?
রাজস্থানের মাউন্ট আবু এর ক্ষেত্রীর রাজা অজিত সিং স্বামীজীর নাম নরেন্দ্রনাথ থেকে বিবেকানন্দ পরিবর্তন করে।
স্বামী বিবেকানন্দের পিতা কি করতেন?
স্বামীজীর পিতা কলকাতা হাইকোর্টের একজন সুপরিচিত এবং দক্ষ আইনজীবী ছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দ গুরু কি ছিলেন?
স্বামী বিবেকানন্দের গুরুর নাম শ্রী শ্রী পরমহংস রামকৃষ্ণ দেব।
স্বামী বিবেকানন্দ পরমহংস রামকৃষ্ণ দেবর সাক্ষাৎ কবে হয়?
তার গুরুর সাথে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৮৮১ সালে।
স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনকে কি হিসেবে পালন করা হয়?
স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনকে জাতীয় যুব দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
স্বামীজী কবে রামকৃষ্ণ মঠ রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্টা করেন?
১৮৯৭ সালে ১ মে রামকৃষ্ণ মঠ, ১৮৯৮ সালের ৯ই রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্টা করে।
স্বামী বিবেকানন্দের প্রথম শিষ্য কে ছিলেন?
স্বামী বিবেকানন্দের প্রথম শিষ্য ছিলেন স্টেশন মাস্টার শরৎচন্দ্র গুপ্ত তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করে “সদানন্দ” নামে পরিচিতি লাভ করেন।
উপসংহার
স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী (Swami Vivekananda Biography in Bengali) থেকে জানতে পারি যে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্যের দেশে প্রচার করা, নারী শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান সত্যেই অনস্বীকার্য। আশা করি এই পোস্টির মাধ্যামে স্বামী বিবেকানন্দের ব্যাপারে অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন। ধন্যবাদ।