শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা – স্বামী বিবেকানন্দ একজন সন্ন্যাসী হবার সাথে সাথে মানুষের পথপ্রদর্শক ছিলেন সেই ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা দর্শন আমরা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও বিভিন্ন ভাষণ এর মাধ্যমে জানতে পারি।
স্বামী বিবেকানন্দ মানবকল্যালনের জন্য শিক্ষার অবদান অসীম বলে মনে করতেন। কিন্তুু তিনি শিক্ষা বলতে তৎকালীন পারম্পরিককে শিক্ষাকে বোঝনি বরং তিনি এমন শিক্ষার কথা বলেছেন যা মানুষ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করতে পারে অর্থাৎ শিক্ষা হবে ব্যবহারিক ও যে শিক্ষার দ্বারা মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশ ঘটবে। তাই স্বামীজী শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন – “মানবের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশ সাধনই হল শিক্ষা।”
স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা-চিন্তা | Swami Vivekananda Thought on Education in Bengali
স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা ও দর্শন – স্বামী বিবেকানন্দ যে শিক্ষা বিস্তারের কথা বলেছেন সেই শিক্ষার মূল ভিত্তি হবে ধর্ম এবং সেই ধর্মে বৈজ্ঞানিক অনুশীলন থাকবে, থাকবে তাত্ত্বিক ভাবনা। তবে স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা চিন্তা একটি ব্যাপক পটভূমিতে বিধৃত হয়েছে।
মানবজীবনের সমস্ত স্তর বা অবস্থার সাথে শিক্ষা কীভাবে যুক্ত থাকতে পারে, সে প্রসঙ্গে তিনি তাঁর নিজস্ব মতবাদ বারবার ব্যক্ত করেছেন। পাশ্চাত্য বিভিন্ন দেশে গিয়ে তিনি শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপক আয়োজন প্রত্যক্ষ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতাকে নিজের দেশে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করেছেন। এই প্রসঙ্গে বলা হয়, সেই সময়কালে স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা সম্পর্কে যা চিন্তা ভাবনা করেছিলেন তা সমকালীন খুব কম মনিষী সেইভাবে শিক্ষা সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করেন।
স্বামী বিবেকানন্দ তার বিভিন্ন গ্রন্থ ও তার ভাষণের মাধ্যমে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি রুপ হওয়া উচিত এবং কেমন শিক্ষা মানব কল্যাণের জন্য গ্রহণ করা উচিত সেই প্রসঙ্গে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। সেই সময় তিনি বলছেন শিক্ষা সবার অধিকার এবং ভারতের সমগ্র মানুষের কাছে শিক্ষা পৌছিয়ে দিতে হবে।
স্বামী বিবেকানন্দ তার শিক্ষা চিন্তায় দুই ধরনের শিক্ষার কথা তুলে ধরেছেন –
- নেতিমূলক শিক্ষা
- দ্বিতীয়টি হলো ইতিবাচক শিক্ষা
নেতিমূলক শিক্ষা – তখনকার দিনে ব্রিটিশ ভারতে আমাদের বিদ্যালয় গুলিতে যে শিক্ষা ব্যবস্থার পদ্ধতি চালু ছিল স্বামীজী তাকে একেবারে নেতিবাচক শিক্ষা বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন নেতিমূলক শিক্ষা কোনো উন্নতি করে না এবং চরিত্র গঠনে জন্য উপযোগী নই। এই শিক্ষা মানুষে মানুষে বিভাজন রেখার জন্ম দেয়। একদল এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অন্য দলের ওপর প্রভুত্ব করার অধিকার অর্জন করে।
ইতিবাচক শিক্ষা – ইতিবাচক শিক্ষা বলতে স্বামীজী যা বলেছেন – “আমরা সেই শিক্ষা চাই, যার দ্বারা চরিত্র গঠিত হয়। মনের জোর বাড়ে, বুদ্ধি বিকশিত হয় এবং মানুষ নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। মানুষ গঠন করাই সমস্ত শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য। স্বভাব অনুযায়ী মানুষকে বর্ধিত হতে দেওয়াই শিক্ষার লক্ষ্য যার দ্বারা ইচ্ছা শক্তি বিকশিত, বর্ধিত এবং সৎভাবে চালিত হয় সেটাই হল ইতিবাচক শিক্ষা।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট অভিমুখ থাকা দরকার। শিক্ষা শুধু টাকা রোজগারের পন্থা হবে না, শিক্ষা আমাদের বিকশিত করবে। আমরা আরও আত্মানুসন্ধানে হয়ে উঠব। পরিদৃশ্যমান পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনাবলী সম্পর্কে আমাদের মনে ঔৎসুক্য জাগবে।
স্বামী বিবেকানন্দের মতে শিক্ষার লক্ষ্য কি হওয়া উচিত?
স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষাদর্শন আলোচনায় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য কি হওয়া দরকার সেই প্রসঙ্গে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জোর দিয়েছেন। স্বামীজির মতে শিক্ষার লক্ষ্য কি হওয়া উচিত সেই ব্যাপারে নিম্নে আলোচনা করা হলো –
(১) আবিষ্কার (২) স্বাধীনতা এবং (৩) আত্মপ্রত্যয় বা আত্মবিশ্বাস
(১) আবিষ্কার – আমরা কী এবং কাকে আবিষ্কার করি? আমরা আবিষ্কার করি নিজের সাহস এবং শক্তিকে। এই পৃথিবীর সকল মানুষই যে বিশ্ববিধাতার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ, সেই বিষয়টি আবিষ্কার করতে হয়। যখন আমাদের মধ্যে সত্যি সত্যি উপলব্ধি জাগ্রত হয়, তখন আমরা পাহাড়ের মতো উঁচু এবং বাতাসের মতো গতিবান হয়ে উঠি।
(২) স্বাধীনতা – শিক্ষার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল স্বাধীনতা। কীসের স্বাধীনতা? চিন্তার স্বাধীনতা ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা, নিজেকে প্রকাশ করার স্বাধীনতা। স্বাধীনতাই শিক্ষার আসল বৈশিষ্ট্য। শিক্ষা মানুষকে স্বাধীনচেতা করে তোলে যার ফলে মানুষ মানসিক, দৈহিক, বৌদ্ধিক, আত্মিক, আধ্যাত্মিক দিক থেকে স্বাধীন হয়ে ওঠে।
(৩) আত্মপ্রত্যয় বা আত্মবিশ্বাস – শিক্ষার তৃতীয় বিষয় হল আত্মপ্রত্যয়। শিক্ষিত মানুষ সবসময় আত্মপ্রত্যয়ী হয়। এই আত্মপ্রত্যয় বা আত্মবিশ্বাস আমাদের জন্য খুব দরকারি, আত্মপ্রত্যয় বা আত্মবিশ্বাস না থাকলে কোনো মানুষ জীবনে সফল হতে পারে না।
নারী শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা
স্বামী বিবেকানন্দের নারী শিক্ষায় অবদান সত্যিই অনস্বীকার্য। তিনি সেই সময়ে নারীদের শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারেন যখন সে সময় মানুষজন নারী শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতেন না। নারীরা শুধুমাত্র সংসারিক কাজ কর্মে লিপ্ত থাকবে সেই ধারণাটি তখনকার দিনে মানুষজন মনে ছিল।
স্বামী বিবেকানন্দ নারী শিক্ষার সেই অবস্থা দেখে তিনি বলতেন – ভাবতে অবাক লাগে যে ভারত একসময় নারীশিক্ষার জন্য প্রগতিমূলক পদ্ধতি প্রচলন করেছিল, যে বৈদিক ভারতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বুদ্ধিজীবী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, সেই ভারত শেষ পর্যন্ত নারীশিক্ষার ওপর কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
কিন্তুু পরবর্তীকালে যখন পাশ্চাত্য সভাতার তখন অনেক বুদ্ধিজীবী এবং শিখব্রতি নারীশিক্ষা সম্পর্কে নতুন করে ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করে। তাদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ নারী শিক্ষার জন্য অন্যতম গুরুত্পূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার পর আস্তে আস্তে মানুষের মন থেকে নারীশিক্ষার প্রতি মনোভাব পরিবর্তন হতে থাকে।
স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শহরে ভ্রমণ করা কালীন, তিনি পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে নারী শিক্ষার উন্নতির ফলে নারীদের প্রগ্রতি দেখে আবক হয়ে গিয়েছিল।
তাই তিনি নিজের দেশে স্বামী বিবেকানন্দ নারীশিক্ষার বিস্তার ও উন্নতি ঘটিয়ে স্বামীজী নারী ও পুরুষকে একই মর্যাদাসম্পন্ন করার কথা বলেন।
বিবেকানন্দ ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতেন যে, নারীকে সুশিক্ষিত না করলে দেশের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। যেহেতু একজন শিশুর শিক্ষা তার মায়ের সান্নিধ্যেই সম্পন্ন হয়, তাই তার মা যদি শিক্ষিত না হয়, তাহলে শিশু শিক্ষিত হবে কী করে।
নারী শিক্ষা সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন – “নারীজাতির উন্নতি এবং জনমার্গের জাগরণ, এই দু’টিরই প্রয়োজন সর্বপ্রথম এবং তখনই দেশের মধ্যে তথা সমগ্র জগতের প্রকৃত কল্যাণ হতে পারে।”
নারী শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান কি?
স্বামী বিবেকানন্দ স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে জন্য অগ্রসর হই কারণ তিনি নারীজাতির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠের বিপরীতে একটি নারী মঠের পরিকল্পনা করেন, যেখানে একটি বালিকা বিদ্যালয় থাকার কথা তিনি বলেছেন। মঠের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব শুধুমাত্র মহিলাদের ওপর ন্যস্ত হবে। পুরুষের মঠে যেমন কেন্দ্রস্থলে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অবস্থান, রমণীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত মঠে তেমনই কেন্দ্রস্থলে থাকবেন শ্রী মা সারদামণি দেবী। তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রহ্মচারিণী ওই মাঠে সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করবেন ও স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করতে পারবে।
স্বামীজী নারী শিক্ষার দুটি বিষয়ে ভাগ করেছেন – (১) আধ্যাত্মিক শিক্ষা (২) দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগবে সেই রকম ব্যবহারিক শিক্ষা
(১) আধ্যাত্মিক শিক্ষা – তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভারতীয় নারীর আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে। তাই ধর্মকে কেন্দ্র করে স্ত্রী শিক্ষার বিস্তার করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ অন্য সমস্ত শিক্ষাই গৌণ। ধর্ম শিক্ষা, চরিত্র গঠন, পালন প্রভৃতির দিকে জোর দিতে হবে।
এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে স্বামীজী চেয়েছিলেন তার মঠে নারীরা সন্ন্যাসী জীবন পালন করবে। তাদের নিয়মিত আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অনুশীলন করা হবে এবং সমস্ত প্রকার যেমন শাস্ত্র, সংগীত, সংস্কৃত, ব্যাকরণ ইত্যাদি পড়ানো হবে। আধ্যাত্মিক শিক্ষা শেষে হাওর পর যদি কেউ মনে করেন যে তারা মঠে থেকে কাজ করবে তাহলে তারা করতে পারে।
তারা মঠে থেকে কি কি কাজ করবে সেই ব্যাপারে স্বামীজি একটি রূপরেখা তৈরি করেন। তারা মঠে থাকার সিদ্ধান্ত নেবে এসব ব্রহ্মচারিণী রাই পরবর্তীকালে শিক্ষয়িত্রী এবং ধর্মপ্রচারক হবেন। এসব শিক্ষয়িত্রী কী কী কাজ করবে, স্বামীজী তারও একটা রূপরেখা নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “এইসব ধর্মপ্রচারিকারা শহর এবং গ্রামে যাবেন। বিভিন্ন জায়গায় নারী শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করবে। সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির নারীদের মধ্যে শিক্ষা প্রচারে ব্রতিনী হবেন। তারা দেশের প্রকৃত স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন।
(২) দৈনন্দিন ব্যবহারিক শিক্ষা – আধ্যাত্মিক শিক্ষার পাশাপাশি স্বামী বিবেকানন্দ নারীদের দৈনন্দিন কাজে লাগবে এমন ব্যবহারিক শিক্ষার কথা স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষাদর্শনে আলোচনা করেন। বিভিন্ন প্রকার ব্যবহারিক শিক্ষা যেমন সেলাই, রন্ধন, ও সংসারী কাজকর্মের শিক্ষা দেবার কথা বলেন। যার ফলে নারীদের কারোর উপর নির্ভরশীল থাকতে হবে না সে তার নিজের বন্দোবস্ত নিজেই করতে পারে। তাতে পুরুষ ও নারীর মধ্যে ভেদাভেদ অনেক তাই কমবে বলে স্বামীজী মনে করতেন।
উপসংহার
অবশেষে বলা যাই, সেই সময়কালে স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষা সম্পর্কে যে মৌলিক চিন্তা ভাবনা করেছেন তা সত্যিই ভাববার বিষয়। স্বামীজী শিক্ষা বলতে শুধু মুখস্থ বিদ্যার কথা বলেননি বরং আধ্যাত্মিক ও সার্বিক বিকাশের কথা বলেন।
আশা করছি আপনাদেরকে স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা চিন্তা সম্পর্কে এই লেখাটি ভালো লেগেছে, এবং স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা দর্শন সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়েছন। ধন্যবাদ।

Abhi Chavan is a digital content creator with 7+ years of experience in quotes, wishes, images, and status content. He manages high-traffic websites in Hindi, Marathi, Kannada, Bengali, and more – helping users express emotions visually and meaningfully.