নমস্কার, আজ আমরা এই পোস্টার মাধ্যমে প্রাচীন ভারতের মহান জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতজ্ঞ আর্যভট্টের জীবনী এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতে তার অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আপনি যদি আৰ্যভট্ট বিষয়ে রচনা লিখতে চান তাহলে এই পোস্ট থেকে আৰ্যভট্ট সম্পর্কে তথ্য নিয়ে নিজের মতন করে আর্যভট্টের রচনা প্রস্তুত করতে পারেন।
আর্যভট্ট কেন বিখ্যাত ছিলেন? Essay on Aryabhata in Bengali
জন্ম | ( ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে – খ্রি ৫৫০) |
জন্মস্থান | অশমাক, মহারাষ্ট্র |
কর্মক্ষেত্র | গণিত, জোতির্বিজ্ঞান |
কর্মস্থল | নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় |
উল্লেখযোগ্য রচনা | আর্যভট্টীয় , আর্যভট্ট সিদ্ধান্ত |
আবিষ্কার | শূন্য এর খোঁজ এবং পাই এর মান |
আর্যভট্ট ছিলেন (৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ – ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ) প্রাচীন গুপ্ত যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ। তিনিই ছিলেন শূন্যের আবিস্কারক। সর্বপ্রথম শূন্যের ব্যবহার তিনি তার গাণিতিক ক্যালকুলেশন এ ব্যবহার করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতের ক্ষেত্রে তার আরো বিভিন্ন কাজ আজও বিজ্ঞানীদের বিস্ময় ও অনুপ্রাণিত করে চলেছে। আর্যভট্ট মাত্র ২৩ বছর বয়সে তার বিখ্যাত রচনা ‘আর্যভটিয়া’ কবিতা আকারে লিখেছেন। আর্যভটিয়া প্রাচীন ভারতের একটি বিখ্যাত গণিতের বই এই বইটিতে দেওয়া বেশিরভাগ তথ্য জ্যোতির্বিদ্যা এবং গোলাকার ত্রিকোণমিতির সাথে সম্পর্কিত। পাটিগণিত, বীজগণিত এবং ত্রিকোণমিতির ৩৩টি নিয়মও ‘আর্যভটিয়া’-এ দেওয়া আছে।
আজ আমরা সবাই জানি যে পৃথিবী গোলাকার এবং তার অক্ষের উপর ঘোরে এবং সেই কারণেই রাত এবং দিন হয়। মধ্যযুগে, ‘নিকোলাস কোপার্নিকাস’ এই তত্ত্বটি উপস্থাপন করেছিলেন কিন্তু খুব কম লোকই এই বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত হবেন যে আর্যভট্ট কোপার্নিকাস এর এই তথ্যটি উপস্থাপন করার এক হাজার বছর আগে গণনা করে তার গ্রন্থ আর্যভটিয়া উপস্থাপন করে। এর সাথে সাথে তিনি আবিষ্কার করেন যে পৃথিবী গোলাকার এবং এর পরিধি প্রায় ২৪৮৩৫মাইল বা ৩৯,৯৬৮ কিলোমিটার।
এছাড়া মহান পণ্ডিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট আরও তার গণনার মাধ্যমে বার করেন যে চাঁদ এবং অন্যান্য গ্রহগুলি সূর্যের রশ্মি দ্বারা আলোকিত হয় এবং আর্যভট্ট তার সূত্র থেকে প্রমাণ করেছেন যে বছরে ৩৬৬ দিন নয়, ৩৬৫.২৯৫১ দিন।
প্রাচীনকালে কোনো রকম আধুনিক যন্তপাতি ছাড়াই তিনি যেসব বিস্ময়কর তথ্য উপস্থাপন ও আবিষ্কার করেন সেই কারণে আর্যভট্ট আজও বিখ্যাত প্রাচীন পণ্ডিতদেড় মধ্যে গণনা করা হয়।
আর্যভট্টের জীবনী – Biography of Aryabhata in Bengali
Essay on Aryabhatta in Bengali
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
আর্যভট্ট তার ‘আর্যভটিয়া’ গ্রন্থে তার জন্মস্থান কুসুমপুর এবং জন্মকাল (৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ – ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন। এ তথ্য থেকে তার জন্ম সময় নিয়ে কোনো রকম বিতর্ক না থাকলেও প্রকৃত জন্মস্থান ও তিনি কোথায় থাকতেন তা নিয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে। কিছু সূত্র অনুসারে, আর্যভট্ট মহারাষ্ট্রের অশমাক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং এটাও নিশ্চিত যে জীবনের কোনো এক সময়ে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য কুসুমপুরায় গিয়েছিলেন এবং সেখানে কিছুকাল বসবাস করেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর ভারতীয় গণিতবিদ ভাস্কর কুসুমপুরাকে পাটলিপুত্র (বর্তমানে বিহারের পাটনা) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অধ্যয়নের একটি বড় কেন্দ্র, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং আর্যভট্ট এর সাথে যুক্ত থাকতে পারে। এটা সম্ভব যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষ সময়ে আর্যভট্ট সেখানে বসবাস করতেন।
আর্যভট্টের বিখ্যাত রচনা
গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আর্যভট্টের তার জ্ঞান মূলত দু’টি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ‘আর্যভট্টীয় ’ একটি, যেটি উদ্ধার করা গিয়েছে। এটি রচিত চার খণ্ডে, মোট ১১৮টি স্তোত্রে। এই গ্রন্থেটি মূলত একটি গাণিতিক বই যেখানে পাটিগণিত, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতির বিশদ বিবরণ রয়েছে। এছাড়াও এতে রয়েছে ক্রমাগত ভগ্নাংশ, দ্বিঘাত সমীকরণ, যোগফল ইত্যাদি।
অন্য যে কাজটি সম্পর্কে জানা যায় সেটি হল ‘আর্য-সিদ্ধান্ত’। ‘আর্য-সিদ্ধান্তের’ কোনও পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া যায়নি তবে বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত এবং প্রথম ভাস্করের দ্বারা লেখা বিভিন্ন গ্রন্থে এটির উল্লেখ মেলে।
এছাড়া আর্যভট্টের তৃতীয় একটি রচনা সম্পর্কে খোঁজ পাওয়া যায়, তবে এটি তার আসল আকারে বিদ্যমান নয়। একটি আরবি অনুবাদের আকারে বিদ্যমান রয়েছে পণ্ডিতদের মতে, আরবি রচনা ‘আল-নাতফ’ এবং ‘আল-নানফ’ আর্যভট্টের রচনাগুলির অনুবাদ। এই লেখাটি আর্যভট্টের রচনার অনুবাদ বলে দাবি করে কিন্তু এর প্রকৃত সংস্কৃত নাম অজানা। এই তথ্যটি পারস্যের পন্ডিত ও ঐতিহাসিক আবু রায়হান আল-বিরুনী উল্লেখ করেছেন।
আর্যভট্টীয়
“আর্যভট্টীয়” আর্যভট্টের দ্বারা রচিত একটি গাণিতিক গ্রন্থ যেখানে পাটিগণিত, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতির বিশদ বিবরণ রয়েছে। এছাড়াও এতে রয়েছে ক্রমাগত ভগ্নাংশ , দ্বিঘাত সমীকরণ, সারণী পাওয়ার সিরিজের, যোগফল ইত্যাদি।
আর্যভট্টের কাজের বেশিরভাগ বর্ণনা মূলত তার রচনা “আর্যভট্টীয় ” থেকে এসেছে। সম্ভবত এই বইটির নামটি আর্যভট্ট নিজে দেননি কিন্তু পরবর্তী সমালোচকরা দিয়েছেন। ভাস্কর প্রথম, যিনি আর্যভট্টের একজন শিষ্য ছিলেন এই রচনাটিকে অশ্মাক-তন্ত্র (Treatise from the Ashmaka) নামে অভিহিত করেছিলেন। সাধারণভাবে একে আর্য–শত–অষ্ট [আর্যভটের ১০৮] ও বলা হয় কারণ এতে ১০৮টি শ্লোক রয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত বিমূর্ত অন্তর্নিহিত সূত্র সাহিত্য, যার প্রতিটি লাইন প্রাচীন জটিল অনুশীলনকে বর্ণনা করে। ১০৮টি শ্লোক এবং ১৩টি সূচনামূলক শ্লোক নিয়ে গঠিত এই রচনাটি ৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত; সেই অধ্যায়গুলো নিম্নরূপ –
গণিতপাদ,
দশগীতিকা,
কালক্রিয়াপদ
গোলপাদ।
দশগীতিকা, কালক্রিয়া ও গোলপাদ অধ্যায়ে গোলীয় ত্রিকোণমিতি ও জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়াবলি রয়েছে। অন্য দিকে গণিতপাদে আছে পাটীগণিত, বীজগণিত, সমতল ত্রিকোণমিতি, দ্বিঘাত সমীকরণ, প্রথম ‘এন’ সংখ্যক স্বাভাবিক সংখ্যার ঘাতবিশিষ্ট পদ সমূহের বর্গ ও ঘনের সমষ্টি এবং একটি সাইন অনুপাতের সারণি রয়েছ। তা ছাড়া এই অধ্যায়ে সে সময়কার জনপ্রিয় জ্যোতিষচর্চার প্রয়োজনীয় ৩৩টি গাণিতিক প্রক্রিয়ার বর্ণনা রয়েছে। গণিতপাদে আর্যভট্ট পাই-এর মান তথা বৃত্তের পরিধির সঙ্গে এর ব্যাসের মান ৩.১৪১৬ হিসাবে চিহ্নিত করেন।
আর্য-সিদ্ধান্ত
আর্য-সিদ্ধান্ত হল জ্যোতির্বিজ্ঞানের গণনার উপর একটি কাজ। এই পাঠ্যটি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং আমরা এটি সম্পর্কে যে সমস্ত তথ্য পাই তা হয় আর্যভট্টের সমসাময়িক বরাহমিহিরের ও গণিতজ্ঞ ভাস্কর এর মতন লেখার মাধ্যমে পেয়ে থাকি। এটি প্রতীয়মান হয় যে এই রচনাটি পুরানো সূর্যসিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে এবং আর্যভটিয়ার সূর্যোদয়ের তুলনায় মধ্যরাত-দিন-গণনা ব্যবহার করা হয়েছে। এই বইয়ে অনেক যন্ত্রের বর্ণনা করা হয়েছে যে জোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রয়োগে ব্যবহার করা হয়। যেমন – শঙ্কু যন্ত্র, ছায়া – যন্ত্র, কোণ পরিমাপ যন্ত্র, জল ঘড়ি,একটি নলাকার লাঠি, বৃত্তাকার যন্ত্র ইত্যাদি।
গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান আর্যভট্টের আবিষ্কার
ভারত ও বিশ্বের গণিত ও জ্যোতিষ তত্ত্বের উপর আর্যভট্টের গভীর প্রভাব রয়েছে। আর্যভট্ট, যিনি ভারতীয় গণিতবিদদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ধারণ করেছেন, ১১৮টি আর্যচন্দে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আর্যভটিয়া’ আকারে জ্যোতিষশাস্ত্র এবং সংশ্লিষ্ট গণিতের তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন।
তিনি গণিতের ক্ষেত্রে আর্কিমিডিসের চেয়ে ‘পাই’-এর মানকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ করেছিলেন এবং জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে তিনিই প্রথম ঘোষণা করেছিলেন যে পৃথিবী তার নিজের অক্ষে ঘোরে।
তিনি আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে কোনো রকম আধুনিক যন্তপাতি ছাড়াই জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আশ্চর্যকর তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন। পৃথিবী যে তার অক্ষের চারদিকে ঘোরে কোপার্নিকাস (১৪৭৩ থেকে ১৫৪৩খ্রিস্টাব্দ) দ্বারা উত্থাপিত করেন কিন্তু এই তথ্য অনেকের কাছে অজানা আর্যভট্ট কোপার্নিকাস এর এই তথ্য উপস্থাপন করার এক হাজার বছর আগেই তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ আর্যভট্টীয় এর গোলপদ বিভাগে এ গণনার মাধ্যমে প্রমান করে বলেছিলেন যে পৃথিবী তার অক্ষের উপর ঘোরে।
এর সাথে সাথে তিনি পৃথিবীর আহ্নিক গতি হিসাবও করেছিলেন। তার হিসেবে পৃথিবীর পরিধি ছিল ৩৯,৯৬৮ কিলোমিটার যা ৪০,০৭৫ কিমি এর আসল মানের থেকে মাত্র 0.2% কম।
গণিতে আর্যভট্টের অবদান
১. আর্যভট্ট শূন্য আবিষ্কার করেছিলেন, যা গণিতের সেরা আবিষ্কার, যার অনুপস্থিতিতে গণনা করা অসম্ভব হয়ে যেত কারণ শূন্যকে সামনে রাখলেই সংখ্যার মান ১০ গুণ বেড়ে যায়। তিনিই প্রথম স্থানীয় মান ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য দেন।
২. আর্যভট্ট পাই এর মান আবিষ্কার করেছিলেন, এর বর্ণনা পাওয়া যায় আর্যভটিয়ার গণিতপদ ১০ এ। তিনি লিখে -:
চার থেকে একশ যোগ করুন, তারপর আট দ্বারা গুণ করুন এবং তারপর ৬২,০০০ যোগ করুন এবং ২0,000 দ্বারা ভাগফল বের করুন, এর থেকে প্রাপ্ত উত্তরটি হবে পাই এর মান অর্থাৎ।
[ ( ৪ + ১০০) * ৮ + ৬২,০০০ ] / ২,০০০ = ৬২,৮৩২ / ২,০০০ = ৩.১৪১৬
৩. আর্যভটিয়ার মঠপদ ৬-এ ত্রিভুজের ক্ষেত্রফলের কথা বলা হয়েছে। আর্যভট্ট সাইনের ধারণা নিয়েও আলোচনা করেছেন, যার নাম তিনি ‘অর্ধ-জ্যা’ সরলতার জন্য একে ‘জ্যা’ বলা হয়।
আর্যভট্ট সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য
- আর্যভট্টের রচিত আর্যভটিয়া এখনও হিন্দু ক্যালেন্ডারে ব্যবহৃত হয়।
- গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর অতুলনীয় অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের প্রথম উপগ্রহের নামকরণ করা হয় ‘আর্যভট্ট’।
- আর্যভট্ট দশমিক পদ্ধতি তৈরি করেন।
- ২৩ বছর বয়সে, আর্যভট্ট ‘আর্যভটিয়া গ্রন্থ’ রচনা করেন, যার উপযোগিতা ও সাফল্য দেখে তৎকালীন রাজা বুদ্ধগুপ্ত তাকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান করেন।
- আর্যভট্ট বিহারের তেরেগানা অঞ্চলে সূর্য মন্দিরে একটি পর্যবেক্ষণ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
- পণ্ডিতদের মতে, আরবি রচনা ‘আল-নাতফ’ এবং ‘আল-নানফ’ আর্যভট্টের রচনাগুলির অনুবাদ।
- আর্যভট্ট কখনই সংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করতে ব্রাহ্মী লিপি ব্যবহার করেননি, যা বৈদিক যুগ থেকে সাংস্কৃতিক রীতি অনুসারে অনুসরণ করা হয়েছিল। তিনি সবসময় শুধু বর্ণমালা ব্যবহার করতেন